প্রতিটি মানুষ কতোগুলো ব্যক্তিগত ও সামাজিক কারণে গৃহের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। মানুষের জীবনের লক্ষ্যসমূহ অর্জনে গৃহের ভূমিকা অপরিসীম। পরিবারের সব সদস্যের আন্তরিক ইচ্ছা, একে অন্যের প্রতি সহযোগিতা ও সমঝোতার মাধ্যমে গৃহেই পরিবারের শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এর জন্য প্রয়োজন হয় সঠিক ও দক্ষ গৃহ ব্যবস্থাপনার। সুষ্ঠু গৃহ ব্যবস্থাপনা একটি সাধারণ গৃহকেও অনন্য সাধারণ করে তুলতে পারে। আর যিনি গৃহ ব্যবস্থাপনার প্রধান দায়িত্বে থাকেন, তিনি হলেন গৃহ ব্যবস্থাপক। পরিবারের মা-বাবা উভয়েই এই ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। গৃহ ব্যবস্থাপক হচ্ছেন গৃহের যাবতীয় কর্মকান্ডের মূল কেন্দ্রবিন্দু। তার ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভর করে পারিবারিক সুখ-শান্তি, স্বচ্ছলতা, সুশৃঙ্খল গৃহপরিবেশ। গার্হস্থ্য অর্থনীতিবিদ নিকেল ও ডরসি (Nickel and Dorsey, 1950) গৃহ ব্যবস্থাপনাকে পারিবারিক জীবনের প্রশাসনিক দিক বলে অভিহিত করেন। গৃহ ব্যবস্থাপক তার শক্তি, সামর্থ্য ও বিভিন্নমুখী দক্ষতার জোরে এ প্রশাসনকে সার্থকভাবে এগিয়ে নিয়ে চলেন। এই গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য গৃহ ব্যবস্থাপকের অভ্যাস ও অনুশীলনের মাধ্যমে অবশ্যই কতোগুলো গুণের অধিকারী হতে হয়। এই গুণগুলো হলো—
বুদ্ধিমত্তা
উদ্দীপনা
বিচারবুদ্ধি
ব্যক্তিত্ব
অধ্যবসায়
সৃজনীশক্তি
অভিযোজ্যতা
মানব প্রকৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান
বুদ্ধিমত্তা— একজন গৃহ ব্যবস্থাপককে অবশ্যই বুদ্ধিমান হতে হয়। ব্যক্তির পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা, জ্ঞানস্পৃহা ইত্যাদি তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়। কোনো সমস্যাকে অনুধাবন করে পরিস্থিতির বিচার- বিশ্লেষণ করা, বিগত দিনের কোনো অভিজ্ঞতাকে সময়মতো কাজে লাগানো এ সবই বুদ্ধির উপর নির্ভরশীল। পারিবারিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে সফল করার জন্য ব্যবস্থাপককে অবশ্যই বুদ্ধিমান হতে হবে। গৃহের সৌন্দর্যবর্ধনে, শৃঙ্খলা আনয়নে, যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন। ব্যবস্থাপক তার বুদ্ধির জোরে পরিবারের সীমিত সম্পদ ব্যবহার করেও সব চাহিদা পূরণ করতে পারেন।
উদ্দীপনা— গৃহ ব্যবস্থাপকের একটি বিশেষ গুণ হলো উদ্দীপনা। উৎসাহ-উদ্দীপনা ছাড়া কোনো কাজেই সফলতা আসে না। যখন যে কাজের প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন সে কাজের গুরুত্ব সম্বন্ধে বিশ্বাস রেখে নিষ্ঠার সাথে কাজটি সম্পন্ন করার চেষ্টাকেই উৎসাহ ও উদ্দীপনা বলা যেতে পারে। গৃহ ব্যবস্থাপকের এই গুণটি অন্য সদস্যের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে যায়। উদ্দীপনা থাকলে আগ্রহ ও আনন্দের সাথে সব কাজ সম্পন্ন করা যায়। আবার দেখা যায় উৎসাহ-উদ্দীপনার অভাবে অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় না। ফলে লক্ষ্য অর্জনও সম্ভব হয় না।
বিচারবুদ্ধি— সংসারে ন্যায়-অন্যায়, ভালোমন্দ ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে নিরপেক্ষ রায় দেওয়ার সামর্থ্য যার ভালো, তাকেই বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই একজন গৃহ ব্যবস্থাপকের বিচার- বুদ্ধি থাকা প্রয়োজন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে নানা রকম জটিলতা দেখা দেওয়াটা স্বাভাবিক। সেসব জটিলতা সমাধান করাও সহজ হয় যদি গৃহ ব্যবস্থাপকের তীক্ষ্ণ বিচার ক্ষমতা থাকে। পরিবারের প্রয়োজনে কোন জিনিসটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আবার কোন জিনিসটি না হলেও চলে এসব ভেবে দেখা ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন গৃহ ব্যবস্থাপকের কাজ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পরিবারের ছোট শিশুটিকে কোন স্কুলে ভর্তি করানো যায়, সে স্কুলের মান, বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব ইত্যাদি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বিচার ক্ষমতার মধ্যে পড়ে।
ব্যক্তিত্ব— মানুষের চাল-চলন, কথা-বার্তা, আচার-আচরণে ও রুচি বোধে ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। একজন গৃহ ব্যবস্থাপককে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে হয়। গৃহ ব্যবস্থাপকের আচার-ব্যবহার এমন হওয়া উচিত যাতে তিনি পরিবারের সকলের নিকট পচ্ছন্দনীয় হতে পারেন তার মার্জিত ব্যবহার, পোষাক-পরিচ্ছদ, কথা- বার্তায় শালীনতা ও পরিমিতি বোধ, ন্যায়পরায়ণতা, দায়িত্ববোধ ইত্যাদি গুণাবলি থাকতে হবে।
সৃজনীশক্তি – গৃহ পরিবেশকে আকর্ষণীয় ও বৈচিত্র্যময় করে তুলতে হলে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে হয়। সেটিই সৃজনশীলতার প্রতীকরূপে সবার নজরে পড়ে। গৃহ ব্যবস্থাপককে এ রকম সৃজনশক্তির অধিকারী হতে হয়, যিনি তার কল্পনাশক্তি দিয়ে নতুনত্ব তৈরি করতে পারেন। সৃজনীশক্তির সাহায্যে গৃহ ব্যবস্থাপকের যে কোনো কাজের পরিকল্পনা করা সহজ হয় এবং কাজের ফলাফল কী হতে পারে সে সম্বন্ধে আন্দাজ করতেও কোনো অসুবিধা হয় না। পূর্ব নির্ধারিত কোনো কাজে যদি পরিবর্তন করতে হয়, তাতেও সৃজনীশক্তি প্রয়োগ করে, তা সহজে করা সম্ভব হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় গৃহ পরিবর্তনের কারণে নতুন ঘরের আসবাবপত্র নির্বাচন, ক্রয় ও বিন্যাসের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপক তার সৃজনীশক্তি ও কল্পনাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারেন।
অধ্যবসায় - অধ্যবসায় ছাড়া কোনো কাজে সফলতা আসে না। যে কোনো কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য শেষপর্যন্ত কাজটি করে যাওয়াটাই হচ্ছে অধ্যবসায়। গৃহ ব্যবস্থাপকের এই গুণের কারণেই যে কোনো কঠিন কাজও সহজেই সম্পন্ন হয়। ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও একাগ্রতা ইত্যাদি গুণাবলী অধ্যবসায়ী হতে সাহায্যে করে। যেমন বিশেষ কোনো নতুন কাজ যদি একবারে রপ্ত করা না যায়, তাহলে বারবার চেষ্টা করে তা রপ্ত করা যায়। গৃহের নানাবিধ কাজের সুষ্ঠু পরিসমাপ্তির জন্য গৃহ ব্যবস্থাপকের এই গুণটি থাকা আবশ্যক। ঘরে শিশুদের পরিচালনা এবং তাদের লেখাপড়া করার ক্ষেত্রে অধ্যবসায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
অভিযোজ্যতা – পরিবর্তনশীল পরিবেশে বাস করার কারণে প্রায়ই আমাদের নানা রকম পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে হয়। যেকোনো পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাওয়ানো বা অভিযোজ্যতার গুণটি প্রত্যেক গৃহ ব্যবস্থাপকের থাকা একান্ত প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে সময়মতো চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। বাড়িতে থাকলে তার বিশেষ যত্ন নিতে হয়। অথবা চিকিৎসকের নির্দেশে হাসপাতালে নিতে হতে পারে। এ রকম পরিবর্তিত অবস্থার সাথে অভিযোজন করে যাবতীয় কাজ সমাধা করতে হয়। গৃহ ব্যবস্থাপককে যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হয়। যিনি যত ভালোভাবে অভিযোজন করতে পারবেন, তিনি যে কোনো পরিস্থিতি সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবেন।
আত্মসংযম – স্বাভাবিকভাবে জীবন চলার মাঝে পরিবারে বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। পারিবারিক সংকটকালে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখাটাই আত্মসংযম। একজন সুব্যবস্থাপকের আত্মসংযমী হওয়া একান্ত প্রয়োজন। এই গুণের মাধ্যমে অনেক কঠিন সমস্যার সমাধান করা যায। আত্মসংযম ক্ষমতা থাকলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখা সহজ হয়। পরিবারে অনেক সময় সদস্যদের মধ্যে নানা রকম ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়ে সম্পর্কের অবনতি হওয়ার আশঙ্কা থাকতে পারে। এ রকম পরিস্থিতিতে গৃহ ব্যবস্থাপক উত্তেজিত না হয়ে নিজেকে সংযত রেখে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন। ফলে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে পরিবারে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়।
মানবপ্রকৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান - মানব চরিত্র সম্পর্কে অধ্যয়ন করার ক্ষমতা গৃহ ব্যবস্থাপকের একটি বিশেষ গুণ । প্রতিটি মানুষই বিভিন্নভাবে একে অন্য থেকে আলাদা। পরিবারে বিভিন্ন ব্যক্তির স্বভাব, আচরণ, পছন্দ, অপছন্দ, মেজাজ-মর্জি ইত্যাদি এক রকমের হয় না। পরিবারে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে হলে পরিবারের সকল সদস্যের সামগ্রিক আচরণগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা প্রয়োজন। একজন গৃহ ব্যবস্থাপক পর্যবেক্ষণ ও অনুশীলনের দ্বারা মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে অবগত হতে পারেন। ফলে তিনি সদস্যদের দ্বারা উদ্ভূত যে কোনো সমস্যা সহজেই মোকাবিলা করতে পারেন। পরিবারে শিশুরা যেমন স্নেহ-ভালোবাসা চায়, তেমনি বড়রা চান শ্রদ্ধা-ভক্তি। আবার শিশুদের নির্দেশ দিয়ে কাজ করাতে হয়, পক্ষান্তরে বড়দের পরামর্শ নিয়ে কাজ করতে হয়। এতে পরিবারে শৃঙ্খলা, শান্তি বজায় থাকে।
উপরোক্ত গুণগুলোর সমন্বয়ে একজন গৃহব্যবস্থাপক উন্নত ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে পারেন। এরকম ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তিকে সবাই মান্য করে এবং তাঁর প্রতি সহযোগী মনোভাব পোষণ করে। ফলে তিনি যে কোনো ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সফল হন।
কাজ – গৃহ ব্যবস্থাপকের গুণাবলি চার্টের মাধ্যমে দেখাও ৷ -
গৃহ ব্যবস্থাপকের নানাবিধ গুণ সম্পর্কে আমরা ইতোমধ্যে অবগত হয়েছি। পরিবারে বিভিন্ন রকম কাজ থাকে। একজন গৃহ ব্যবস্থাপক তার করণীয় কাজগুলো সম্পর্কে সচেতন হয়ে তার গুণাবলির প্রকাশ ও বিকাশ ঘটাতে পারেন। তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে তাকে সব সময় সচেষ্ট থাকতে হয়। গৃহ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব ও কর্তব্যে সামান্য অবহেলার কারণে পারিবারিক জীবনে অনেক বিপর্যয় ঘটতে পারে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য পরিবারের ছোট-খাটো কাজ থেকে বড় রকমের বিভিন্ন গুরুদায়িত্ব পালনের ভারও গৃহব্যবস্থাপকের উপর ন্যস্ত থাকে। তাকে পরিবারের সার্বিক কাজের দায়িত্বে থাকতে হয়। সকল কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করানো গৃহ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তার সঠিক নির্দেশনা পেলে অন্য সদস্যরাও কাজে আগ্রহী হয়ে উঠে।
পরিবারের সীমিত সম্পদের সদ্ব্যবহার করে কীভাবে প্রয়োজনীয় সকল চাহিদা মেটানো যায়, গৃহ ব্যবস্থাপককে তার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এ ছাড়া নির্ধারিত কাজগুলো কে করবে, কীভাবে করা হবে, কখন এবং কেন করা হবে এসব বিষয়ের প্রতি সচেতন হয়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করাটা গৃহ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। সদস্যদের মধ্যে কাজগুলো বণ্টন করে, তার সার্বিক তদারকি করাটাও তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের আওতাভুক্ত।
পরিবারে গৃহব্যবস্থাপকের দায়িত্ব ও কর্তব্য
গৃহে সুষ্ঠু কর্ম ব্যবস্থা সৃষ্টি করা- পারিবারিক কাজগুলো সকল সদস্যের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া গৃহ ব্যবস্থাপকের অন্যতম দায়িত্বের অন্তর্গত । পরিবারে এমন অনেক কাজ আছে যা গৃহের মধ্যেই সম্পাদিত হয়। যেমন-রান্না ও পরিবেশন করা, ঘর-বাড়ি পরিষ্কার ও পরিপাটি রাখা, কাপড় ধোওয়া, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ায় সাহায্য করা, বয়স্ক বা অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করা, চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। আবার কিছু কাজ বাড়ির বাইরে করতে হয়। যেমন-বাজার করা, লন্ড্রিতে যাওয়া, বাগান করা, আত্মীয়স্বজনের খোঁজ খবর নেওয়া ইত্যাদি। গৃহ ব্যবস্থাপক পরিবারের সদস্যদের শক্তি, সামর্থ্য, বয়স, কর্মস্পৃহা ইত্যাদির ভিত্তিতে কাজগুলোকে বিভিন্ন সদস্যের মধ্যে বণ্টন করে থাকেন। কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাজগুলোর তদারকি করা ও সদস্যদের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব পোষণ করা গৃহ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব।
পরিবারের আয় ও ব্যয়ের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা- পরিবারে সকলের সব রকম চাহিদা পূরণের জন্য আয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয়। আয়ের মাধ্যমে পরিবার যে অর্থ উপার্জন করে তার দ্বারাই প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্য সামগ্রী ও সেবা ক্রয় করা হয়। আয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত থাকলে পরিবারে অভাব-অভিযোগ থাকে না। ফলে সেখানে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিরাজ করে। গৃহ ব্যবস্থাপকের এ বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হয়।
আয়কে যথাযথভাবে ব্যবহারের প্রতিও গৃহব্যবস্থাপককে যথেষ্ট সচেতন থাকতে হয়। আয় অনুযায়ী ব্যয় করার জন্য তাকে অর্থ ব্যয়ের পূর্ব পরিকল্পনা করতে হয়, যা বাজেট হিসেবে পরিচিত। পরিবারের সীমিত আয়ের মধ্যে সুষ্ঠু ব্রুয় নীতি অনুসরণ করে পরিবারের সব রকম চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করতে হয়। এর পাশাপাশি ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য আয়ের কিছু অংশ সঞ্চয় করে রাখার ব্যবস্থা করাও গৃহ ব্যবস্থাপকের কাজ। তার সুষ্ঠুভাবে অর্থ ব্যবস্থাপনার ফলে, পরিবারের সকল সদস্যের মধ্যে ব্যয় করার সদভ্যাস গড়ে উঠে, তারা মিতব্যয়ী ও সঞ্চয়ী মনোভাব সম্পন্ন হতে পারে।
পরিবারের সদস্যদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা- পরিবারে বিভিন্ন বয়স ও সম্পর্কের সদস্যরা অবস্থান - করে। গৃহ ব্যবস্থাপনার সাথে একাধিক কাজ সম্পৃক্ত থাকে। পরিবারের সকল সদস্যের মিলিত প্রচেষ্টায় কাজগুলো সম্পন্ন হয়। সদস্যদের মধ্যে আন্তসম্পর্ক যদি ভালো হয়, তাহলে সেখানে সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করে। গৃহ ব্যবস্থাপক নিজে অন্যান্য সদস্যদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখবেন। এ ছাড়াও অন্য সদস্যরাও যেন একে অন্যকে শ্রদ্ধা করেন, মর্যাদা দেন সে বিষয়েও তাকে সচেতন থাকতে হবে। পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজন ও চাহিদার কথা বিবেচনা করে, সেগুলো সম্ভাব্য সহজ উপায়ে মিটানোর পদক্ষেপ নিতে হয়। অনেক সময় পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তির সাথে নবীনদের মতের অমিল থেকে মনোমালিন্যর সৃষ্টি হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রবীণ ও নবীনদের প্রকৃতি অনুধাবন করে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার দায়িত্ব গৃহ ব্যবস্থাপকের। সকল সদস্যের যুক্তিসংগত চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারলে গৃহ ব্যবস্থাপকের সাথে তাদের সম্পর্কের উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটতে থাকে।
পরিবারের সুষ্ঠু নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গৃহ ব্যবস্থাপককে পরিবারের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে বিশেষভাবে যত্নবান হতে হবে। গৃহ, গৃহের সদস্যগণ এবং পণ্যসামগ্রীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয়। গৃহ যাতে নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে। বাসস্থানের নিরাপত্তার জন্য অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা, পয়ঃনিষ্কাশনের সুব্যবস্থা ও ময়লা আবর্জনা যথাযথ স্থানে অপসারণ করা, গৃহকে দূষণমুক্ত রাখা ইত্যাদি গৃহের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব গৃহব্যবস্থাপকের। গৃহের সকল সদস্যের দৈহিক ও মানসিক নিরাপত্তার বিষয়টির প্রতি যত্নবান হতে হবে। বাড়িতে সদস্যরা কোনো দুর্ঘটনায় পড়লে, তাকে সাময়িক আরাম দেওয়ার জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা সামগ্রীর ব্যবস্থা রাখতে হবে। বিপজ্জনক দ্রব্যসামগ্রী নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। অসুস্থ ব্যক্তির সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করে তার সুস্থতা নিশ্চিত করতে হবে। পণ্যসামগ্রীর নিরাপত্তার জন্য গৃহে সুষ্ঠু সংরক্ষণ কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা গৃহ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব।
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সুষ্ঠু ভোগ আচরণ গড়ে তোলা – বর্তমান যান্ত্রিক জীবন ও বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে গৃহ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব ও কর্তব্য আরও বেড়েছে। পরিবর্তনশীল জগতের সাথে মিল রেখে সন্তানদের মানসিক বিকাশ হচ্ছে কি না তা লক্ষ রাখতে হয়। সেজন্য বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সুযোগ- সুবিধা সমূহ পরিবারের ছেলেমেয়েরা যাতে ভোগ করতে পারে, তার যথাযথ ব্যবস্থা করাও গৃহ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব। এ ছাড়া সদস্যদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদির চাহিদা পূরণে সঠিক পণ্য নির্বাচন ও ব্যবহারের প্রচেষ্টা থাকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ খাদ্য নির্বাচন সুষম হতে হবে, বস্ত্র নির্বাচন প্রয়োজন ও সামাজিক রীতিনীতি অনুসারে হতে হবে, বাসস্থান স্বাস্থ্যকর হওয়া প্রয়োজন। এ সকল লক্ষ্য অর্জনে গৃহ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া, যাতে সাধ্যের মধ্যে সদস্যদের চাহিদাগুলো পূরণ হয়। গৃহের সীমিত সম্পদের উপযোগ বা অভাব পূরণের ক্ষমতা বাড়িয়ে কীভাবে প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটানো যায়, সে প্রচেষ্টা গৃহ ব্যবস্থাপককে নিতে হবে।
কাজের উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখা পরিবারের সকল সদস্য যেন তাদের করণীয় কাজগুলো ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারে, সেজন্য কাজের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা গৃহ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব। কাজের পরিবেশ উন্নত ও আরামদায়ক হলে উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে কাজ করা সম্ভব হয়। যেমন— লেখাপড়া করার জন্য যথেষ্ট আলো-বাতাস পূর্ণ এবং কোলাহলমুক্ত একটি স্থানের প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া বই-খাতা, কলম, পেনসিল ইত্যাদি শিক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো সঠিকভাবে নির্দিষ্ট স্থানে গোছানো থাকলে সহজেই সেগুলো ব্যবহার করা যায়। এ রকম পরিবেশে নির্বিঘ্নে ও আরামদায়ক অবস্থায় লেখাপড়া করা যায়। একইভাবে প্রতিটি কাজ অনুযায়ী কাজের ভালো পরিবেশ বজায় রাখার ব্যপারে গৃহ ব্যবস্থাপককে দায়িত্ব নিতে হয়।
উপরোক্ত কাজের দায়িত্ব পালন ছাড়াও গৃহ ব্যবস্থাপককে পরিবারে আরও অনেক অনুষ্ঠান, উপলক্ষ ও বিভিন্ন ঋতুর সাথে সম্পর্কিত নানাবিধ কর্মকান্ডের আয়োজন করতে হয়। আর সেসব কর্মকান্ডের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতি স্তরে ব্যবস্থাপককে বিভিন্নমুখী গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়।
একথা মনে রাখতে হবে যে, গৃহ ব্যবস্থাপক গৃহের সার্বিক ব্যবস্থাপনার গুরুদায়িত্ব বহন করেন। তাকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করা প্রত্যেক সদস্যের কর্তব্য। তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে, তার আদেশ, নির্দেশ পালন করে সবাই মিলে পারিবারিক কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে। পরিবারের কর্মকান্ডগুলো গৃহ ব্যবস্থাপকের সুচারু ব্যবস্থাপনার দ্বারা সম্পাদিত হয়। তিনি যাতে এ রকম দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সফল হতে পারেন সেজন্য প্রত্যেক সদস্যকে যার যার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে নিষ্ঠাবান হতে হবে। তাহলেই আশা করা যাবে যে, সুষ্ঠু গৃহ ব্যবস্থাপনার দ্বারা পরিবার তার লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে।
কাজ – তোমার পরিবারের গৃহ ব্যবস্থাপককে তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে তুমি কীভাবে সহযোগিতা করতে পার? তা ক্রমানুসারে সাজিয়ে লেখ।
পরিবার হলো সমাজের মূল ভিত্তি। পরিবারের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যরা সামাজিক রীতিনীতি, মতাদর্শ ও সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা পায় এবং সামাজিকভাবে গড়ে উঠে। গৃহ ব্যবস্থাপক পরিবারের সদস্যদের এবং নিজেকে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানে সম্পৃক্ত করে সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে অবদান রাখতে পারেন। যেমন- লিও ক্লাব, গার্ল গাইড, রেড ক্রিসেন্ট ইত্যাদিতে সম্পৃক্ত হয়ে বিভিন্ন দুর্যোগাকালীন আর্ত মানবতার সেবায় নিয়োজিত হতে পারেন ।
গৃহ ব্যবস্থাপক পরিবারে সদস্যদের সামাজিক রীতিনীতি শিক্ষা দিয়ে সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে মেলামেশা ও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে ব্যবস্থা নিতে পারেন। শিষ্টাচার, আদর্শ মূল্যবোধ শিক্ষাদানের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। পরমতসহিষ্ণুতা, বিপদে ধৈর্যধারণ, অন্যকে সাহায্য করা, সমাজপ্রীতি শিক্ষা দানের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের নৈতিক চরিত্রে অধিকারী করতে পারেন। এতে সামাজিক অবক্ষয়তা রোধের পাশাপাশি বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ রোধ করা সম্ভব হবে।
গৃহ ব্যবস্থাপক মা-বাবা যিনি হোন না কেন তাকে পরিবারের সদস্যদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, স্নেহ- ভালবাসা শিক্ষাদানের পাশাপাশি প্রতিবেশিদের প্রতি দায়িত্ববোধ, সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহনে আগ্রহী করে তুলতে হয়। যেমন- বিয়ে, জন্মদিন, মিলাদ, ঈদ, পুজা, বড়দিন, মৃত্যুবার্ষিকী, অসহায় ও দুস্থদের সাহায্য করা ইত্যাদি বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের শিক্ষাদান একজন গৃহ ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
গৃহ ব্যবস্থাপক জাতি, জাতীয় অনুষ্ঠান, নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে তার পরিবারের সদস্যদের শিক্ষা দানের মাধ্যমে দয়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। আর যখন গৃহ ব্যবস্থাপক সদস্যদের সামাজিক রীতিনীতি শিক্ষাদানের মাধ্যমে সামাজিকভাবে গড়ে তুলতে পারবেন তখন গৃহ ব্যবস্থাপকের সামাজিক দায়িত্ব পালন যথাযথ হয়েছে বলে মনে করা হবে।